bartamantripura.com

প্রতিদিনের ত্রিপুরা,বর্তমান ত্রিপুরা – ত্রিপুরার কথা, প্রতিদিনের বার্তা।

প্রদীপ দত্ত ভৌমিকের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ত্রিপুরার সংবাদমাধ্যম জগৎ


ত্রিপুরার সংবাদ জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে চলে গেলেন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর প্রাক্তন নিউজ এডিটর এবং উত্তর–পূর্ব ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকের অন্যতম স্তম্ভ, প্রদীপ দত্ত ভৌমিক। ৭৩ বছর বয়সে দিল্লির এইমসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সংবাদমাধ্যমে নিষ্ঠা, নির্লিপ্ততা এবং নিরবিচারে কাজ করার জন্য তিনি ছিলেন সর্বজনস্বীকৃত এক নিঃশব্দ লড়াকু। তিনি ছিলেন ত্রিপুরার সাংবাদিকতার কিংবদন্তি ভূপেন দত্ত ভৌমিকের ভাগ্নে।

১৯৫৩ সালের ১ জানুয়ারি, বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চন্দিনা উপজেলাধীন আলকিমুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রদীপ দত্ত ভৌমিক। দেশভাগ-পরবর্তী সহিংসতার সময় তাঁর পরিবার ত্রিপুরায় চলে আসে। আগরতলার নেতাজি সুভাষ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি বোধ্যজং বয়েজ স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন এবং সফলভাবে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৭৩ সালে এমবিবি কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপরই তাঁর মামা ও ‘দৈনিক সংবাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ভূপেন দত্ত ভৌমিকের অনুপ্রেরণায় সংবাদপত্রে কর্মজীবনের সূচনা হয়। যদিও ১৯৭৯ সালে তিনি সবরুমের মনুবাজার স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান সাংবাদিকতার শুরু হয় ‘দৈনিক সংবাদ’-এ তাঁর মামা সঙ্গে কাজ করে। কিছুদিন শিক্ষকতার পরে আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৮৮ সালে নিউজ এডিটর, পরে ১৯৯৬ সালে পত্রিকার প্রিন্টার ও প্রকাশক নিযুক্ত হন। এই পদে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। অদম্য পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও নির্লিপ্ত মানসিকতা ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি কখনও কোনও বিতর্কে জড়াননি, এবং রাজনীতি ও ক্ষমতার মোহ থেকে নিজেকে বরাবর দূরে রেখেছেন।

প্রদীপবাবুর সরলতা ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন শান্ত, সংযত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি তৎকালীন সিপিআই(এম)-এর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। দলীয় প্রভাব বা হুমকি তাঁকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। অসংখ্য দুর্নীতির খবর তিনি জনসমক্ষে এনেছেন। ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় সরকার পরিবর্তনের পরেও তিনি নিরপেক্ষতার পথ ছাড়েননি। যেকোনও রাজনৈতিক শাসনকালেই তিনি সত্য প্রকাশে পিছপা হননি।

তবে দীর্ঘদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তাঁকে দিল্লির এইমসে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তাঁকে আর সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। ৭৩ বছর বয়সে দিল্লির এইমসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি

তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘নর্থইস্ট কালারস’ এবং ‘ইমপ্রিন্ট’-এর দপ্তরে নেমে আসে শোকের ছায়া। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা সহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সহকর্মীরা গভীর শোকপ্রকাশ করেন।

‘দৈনিক সংবাদ’ সূত্রে জানা গেছে, তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, এক বিবাহিত কন্যা এবং অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। আজ তাঁর মরদেহ বিমানে আগরতলায় নিয়ে এসেছেন এবং আজ দুপুরে প্রদীপ দত্ত ভৌমিকের মরদেহ আগরতলায় এসে পৌঁছালে প্রথমে তাঁকে তাঁর নিজ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডাঃ মানিক সাহা উপস্থিত থেকে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান এবং তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণা করেন। তিনি প্রদীপবাবুর নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা ও ত্রিপুরার সংবাদ জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ করেন।

এরপর মরদেহ আগরতলা প্রেস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সাংবাদিক সহকর্মীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, উল্লেখ যোগ্য ভাবে প্রেস ক্লাব সভাপতি প্রণব সরকার এবং আগরতলার মেয়র দীপক মজুমদার তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান। পরে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বটতলা মহাশ্মশানে, যেখানে আজ তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

সূত্রের খবর অনুযায়ী, তাঁর সুযোগ্য পুত্র প্রাবুদ্ধ দত্ত ভৌমিককে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর পরবর্তী প্রকাশক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছেপ্রাবুদ্ধ একজন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ছাত্রজীবনে দৈনিক সংবাদ-এ ইন্টার্নশিপ করেছেন। সাংবাদিকতার পরিবেশ ও দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। শান্ত স্বভাব, ভদ্র ব্যবহার এবং পিতার মতোই আদর্শবাদী মানসিকতা তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত করে তুলেছে।

প্রাবুদ্ধ দত্ত ভৌমিকের মধ্যে তাঁর বাবার মতই সততা, মেধা ও একাগ্রতা দেখা যায়। তাঁর নেতৃত্বে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাধিকার সুরক্ষিত থাকবে বলে সংবাদমাধ্যমের অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন।

প্রদীপ দত্ত ভৌমিকের প্রয়াণে ত্রিপুরা তথা উত্তর–পূর্ব ভারতের সংবাদজগতে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো, যা সহজে পূরণ হবার নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *